বাংলাদেশ নামটি কীভাবে এলো
আমরা যারা বাংলাদেশী তাদেরকে নিজ দেশের নাম বলতে বললে সকলে এক বাক্যে বলবে ‘আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ।’ হ্যাঁ। কথাটি মিথ্যে নয়। তবে ভাইবা বোর্ডে এই উত্তরটি সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্যও নয়। বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রটির নাম “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।” এই গণপ্রজাতন্ত্রী মানে কী? বাংলাদেশ নামটিই বা কীভাবে এল? এসব ইতিহাস নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন। একজন বাংলাদেশী হিসেবে এই বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা না রাখা প্রতিটি নাগরিকের জন্য অত্যন্ত লজ্জার। তবে চলুন জেনে নেওয়া যাক।
…..
বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম
যে কোন রাষ্ট্র তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন তার সংবিধান। সংবিধান অনুযায়ীই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের এক নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী,
“বাংলাদেশ একটি একক স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যাহা “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ” নামে পরিচিত হইবে।”
অর্থাৎ বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’।
এই গণপ্রজাতন্ত্রী কথাটি গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র এই দুটি শব্দের সমষ্টি। আর বাংলাদেশ শব্দটি আমাদের ভাষার নাম অর্থাৎ `বাংলা’ এর সাথে ফারসি শব্দ `দেশ’ যোগে গঠিত হয়েছে।
গণপ্রজাতন্ত্র শব্দের ব্যাখ্যা জানতে পাঠক “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ এক: প্রজাতন্ত্র” এই অনুচ্ছেদটি পড়তে পারেন।
এখানে কেবল বাংলাদেশ নামের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা হবে।
প্রাগৈতিহাসিক যুগে ‘বঙ্গ’
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের নামের পেছনে রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। যার শুরু সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে।
শিকারি যুগে এ অঞ্চলে কিছু যাযাবর লোক বাস করলেও তাদের সভ্যতা সংস্কৃতি বলতে কিছু ছিল না। ফলে অঞ্চলটির কোন নামও ছিল না। নেগ্রিটোরা অল্প বিস্তর কৃষিকাজ জানত বলে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। পরবর্তীতে অস্ট্রিক, দ্রাবিড়রা এসে এ অঞ্চলে বসবাস করে। তবে এ পর্যন্ত অঞ্চলটির কোন নামকরণ পাওয়া যায়নি।
মূলত আর্যরা ভারতবর্ষে আসার পরই (খ্রি. পূ. ১৫০০ অব্দ) নামকরণ শুরু হয়। ধারণা করা হয় আর্যদের অর্ধ-যাযাবর এক গোত্র ‘জন’ থেকে ‘জনপদ’ শব্দের উৎপত্তি। এই ‘জনপদ’ শব্দের অর্থ ‘রাজ্য’। সম্ভবত খ্রি. পূ. ১০০০ অব্দের দিকে দ্রাবিড়ীয় একটি জাতিগোষ্ঠী ‘বং’ বা ‘বাং’ থেকে আর্যরা এ অঞ্চলের নামকরণ করে ‘বঙ্গ’। গঙ্গা ভাগীরথীর মধ্যবর্তী এই ভূমিটি এভাবেই সর্বপ্রথম বঙ্গ নামে পরিচিত হয়। ‘বঙ্গ’ একটি সংস্কৃত শব্দ।
বঙ্গ জনপদের পাশাপাশি আরও কয়েকটি জনপদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পুন্ড্র, গৌড়, বরেন্দ্র, রাঢ়, চন্দ্রদ্বীপ, সমতট, হরিকেল ইত্যাদি।
প্রাগৈতিহাসিক যুগে কোন লিখিত নিদর্শন না থাকায় বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের নামকরণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে বঙ্গ নামকরণের কারণ হিসেবে এ মতবাদটিই অধিক প্রসিদ্ধ।
এছাড়া অন্যান্য মতবাদের মধ্যে হিন্দু পুরাণের কথা উল্লেখ করা যায়। হিন্দু পুরাণ অনুসারে রাজা বলির পুত্র অঙ্গ, বঙ্গ, পুন্ড্র এসব অঞ্চল শাসন করতেন বলে তাদের নামানুসারে এসব জনপদের নাম দেওয়া হয়েছে।
প্রাচীন যুগের ‘বঙ্গ’
প্রাগৈতিহাসিক যুগে দেওয়া বঙ্গ নাম প্রাচীন যুগে অপরিবর্তিত থাকে। মৌর্য শাসনামলে (খ্রি.পূ. ৩২১ থেকে খ্রি, পূ, ১৮৫) সম্রাট অশোক বাংলা অঞ্চলকে মগধ মহাজনপদের অন্তর্ভুক্ত করে।
মৌর্যদের পর গুপ্তরা বাংলার এসব অঞ্চল শাসন করে। গুপ্ত বংশের পতনের পর গুপ্ত রাজার এক মহাসামন্ত শশাঙ্ক স্বাধীন বঙ্গ ও গৌঢ় রাজ্য স্থাপন করে। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর এক অরাজকতাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ইতিহাসে একে অভিহিত করা হয়েছে ‘মৎস্যান্যায়’ নামে। এ অবস্থার সমাপ্তি ঘটাতে সর্বসম্মতিক্রমে গোপালকে বঙ্গের রাজা ঘোষণা করা হয়। শুরু হয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল বংশের শাসন। পালদের দীর্ঘদিন (প্রায় ৪০০ বছর) বঙ্গ শাসনের পর হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেন বঙ্গ বাংলা শাসন করতে থাকে।
মধ্যযুগে ‘বাঙ্গাল’, ‘বাংলা’ ও বঙ্গ
তুর্কি বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি সেন রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বঙ্গ দখল করে। শুরু হয় বঙ্গে মুসলিম শাসিত মধ্যযুগ।
মুসলিম শাসনামলে আর্যদের দেওয়া সংস্কৃত ‘বঙ্গ’ শব্দের সাথে ফারসি ‘আল’ প্রত্যয় যোগ হয়ে গঠিত হয় ‘বাঙ্গাল’ বা ‘বাঙ্গালাহ্’ শব্দ। এই ‘আল’ মানে হচ্ছে জমিকে বিভক্তকারী সরু বাঁধ বা নদীর উপরের বাঁধ। অর্থাৎ আর্যদের দেওয়া সংস্কৃত বঙ্গ নাম মুসলিম শাসনামলে ফারসি বাঙ্গাল-এ রুপান্তরিত হয়। তখন থেকেই বাঙ্গাল নামটি জনপ্রিয় হতে থাকে। তবে দেশবাচক ‘বাংলা’ শব্দ সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয় সম্রাট আকবরের সভাকবি আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে।
মধ্যযুগ তথা মুসলিম শাসনামলের শেষের দিকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব নবাব সিরাজদ্দৌল্লা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের কিছু অংশকে আবার বঙ্গ নাম দেন।
আধুনিক যুগে ‘পূর্ববঙ্গ’
নবাবদের পর ব্রিটিশরা বাংলার অধিকার পায়। বাংলাকে তারা বলত ‘বেঙ্গল’। শাসনকার্যের সুবিধার্থে তারা বেঙ্গল বা বঙ্গকে ভাগ করে যা ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত। বঙ্গভঙ্গের ফলে সৃষ্টি হয় পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ। তবে বাঙালিদের কাছে বঙ্গভঙ্গ মাকে ভাগ করার সমান ছিল। ফলে তারা আন্দোলন করে। চাপে পড়ে সরকারকে বঙ্গভঙ্গ রদ বা বাতিল ঘোষণা করতে হয়। কিন্তু ব্রিটিশরা দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় বঙ্গকে আবার ভাগ করে যায়। পশ্চিমবঙ্গ হয়ে যায় ভারতের অংশ আর পূর্ববঙ্গ হয় পাকিস্তানের অংশ।
পাকিস্তান আমলে ‘পূর্ব পাকিস্তান’
পাকিস্তান জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালিদের উপর বিমাতাসুলভ আচরণ শুরু করে। বাংলার ইতিহাসকে মুছে দিতে পাকিস্তানি শাসকরা রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দূকে স্থান দিতে চায়। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্ভুদ্ধ হয়ে বাঙালিরা সংগ্রাম করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান করতে বাধ্য করে। ১৯৫৫ সালের ৭ জুলাই ‘মারি চুক্তি’র মাধ্যমে পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়। তবে এ নাম কেবল কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাঙালিরা এ নাম মেনে নেয়নি। পূর্ব বাংলা বলতেই তারা অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। এমনকি ১৯৫৭ সালে তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান নামের প্রতিবাদও করেন। তিনি বলেন,
“পূর্ব বাংলা নামের একটি ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে। আর যদি পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতেই হয়, তাহলে বাংলার মানুষের জনমত যাচাই করতে হবে। তারা নামের এই পরিবর্তন মেনে নিবে কিনা – সেজন্য গণভোট নিতে হবে।”
‘বাংলাদেশ’নামকরণ
১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের গোপন ছাত্র সংগঠন নিউক্লিয়াস প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তারা বাংলাকে স্বাধীন পূর্ব বাংলা বলে অভিহিত করত। ১৯৬৯ এর গণঅভুত্থানের সময় আইয়ূব খানের পতনের নিমিত্তে নিউক্লিয়াসের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খানের স্লোগান
“বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”
বেশ জনপ্রিয়তা পায়। বাংলা এর সাথে ফারসি শব্দ দেশ মিলে বাংলাদেশ!!! আহ্! কি চমৎকার নাম। ইতিহাস বলে এটিই প্রথম বাংলাদেশ নামের ব্যবহার।
তারপর ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশটির নামকরণের জন্য অনেকে অনেক নাম প্রস্তাব করে।
সাহিত্যে বাংলা অঞ্চলের যেসব নাম আমরা পাই। যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যে বঙ্গদেশ, কাজী নজরুলের কবিতায় বাংলাদেশ, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় সোনার বাংলা, জীবনানন্দের কবিতায় রূপসী বাংলা। সত্যজিত রায়ের লেখায় বাংলাদেশ ইত্যাদি সব উপস্থাপন করা হয়।
বাংলাদেশ নামকরণের প্রস্তাব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, ‘১৯৫২ সালে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বাংলা ভাষা থেকে ‘বাংলা’, এরপর স্বাধীন দেশের আন্দোলন সংগ্রাম থেকে দেশ। এই দুটো ইতিহাস ও সংগ্রামকে এক করে ‘বাংলাদেশ’ নামকরণ করা হয়।
সকলে এক বাক্যে তা স্বীকার করে নেয়। ৬ ডিসেম্বর পত্রিকায় সর্বপ্রথম বাংলাদেশ নামকরণের কথা দেশবাসী জানতে পারে। তারপর থেকে সকলে মনে প্রাণে বাংলাদেশ নামকে স্বীকৃতি দেয়।
‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা
সবশেষে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ও পরবর্তীতে মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণপত্রে নতুন দেশকে ‘বাংলাদেশ’ নামেই অভিহিত কর হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান প্রণয়ন করে নাম রাখা হয় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’।
এটিই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাম ও নামকরণের ইতিহাস।
তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইংরেজি বাংলাদেশ শব্দের প্রতিটি বর্ণ দিয়ে একটি শব্দ যোগ করে বাংলাদেশে নামের একটি সুন্দর অর্থ দাড়ঁ করানো হয়েছে। কে বা আরা তা আবিষ্কার করেছে তা জানা যায়নি। তবে অর্থটি এরূপ:
- B-Blood
- A-Achieve
- N-Noteworthy
- G-Golden
- L-Land
- A-Admirable
- S-Sacred
- H-Habitation

অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ’ এর পূর্ণ অর্থ হল ‘রক্তে অর্জিত স্মরণীয় সোনালি ভূমি প্রশংসিত
গণতান্ত্রিক চিরসবুজ পবিত্র বাসভূমি’।