মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ দুটি নদী ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস। বর্তমান ইরাকের বেশির ভাগ এলাকা, ইরান, সিরিয়া ও তুরস্কের কিছু অংশ ছিল নদী দুটির অববাহিকা অঞ্চল। পলির কারণে অত্যন্ত উর্বর এই স্থান কৃষিকাজের জন্য ছিল বেশ উপযোগী। নদীতে মাছও ছিল প্রচুর। অর্থাৎ সদ্য কৃষিকাজ শেখা মানুষগুলোর জন্য বসবাসের জন্য স্থানটি ছিল বেশ চমৎকার। ফলে বিভিন্ন স্থান থেকে মানব গোষ্ঠী এখানে এসে বসতি গড়ে তুলে। মানব ইতিহাসের প্রথম স্থায়ী আবাস গড়ে উঠে।

গ্রিকরা এই অঞ্চলের নামকরণ করেছিল ‘মেসোপটেমিয়া (Mesopotamia)’।
যার অর্থ ‘দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল’।
‘মেসো’ অর্থ ‘দুই’ এবং ‘পটেমিয়া’ অর্থ ‘নদী’।
এই মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের মানুষগুলোই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। যাকে আমরা মেসোপটেমিয়া সভ্যতা নামে চিনি। ব্যাবিলনীয়, অ্যাসিরীয়, সুমেরীয়, ক্যালডীয় প্রভৃতি জাতির দীর্ঘ দিনের অবদানে জন্ম হয় এই সভ্যতার। ‘সভ্যতার আঁতুড়ঘর’ বলা হয় একে। কারণ অন্য সব সভ্যতার উদ্ভব এই মেসোপটেমীয়া সভ্যতা থেকেই হয়েছে।
তো কেমন ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম সভ্যতা? মানুষ কেন ও কীভাবে সভ্যতাটি গড়ে তুলেছিল? তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে কতটুকু উন্নতি করতে পেরেছিল? উৎসুক মনে এরুপ অসংখ্য প্রশ্ন জাগা খুবই স্বাভাবিক। আর এসব প্রশ্নের উত্তর দিতেই আমাদের আজকের নিবেদন ‘মেসোপটেমিয়া সভ্যতা’।
সভ্যতার পর্যায়
আনুমানিক ৭০০০ বছর পূর্বে এই সভ্যতার সূচনা হয়। কিন্তু এটি পরিপূর্ণতা লাভ করে ৫০০০ বছর পূর্বে।
মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের ছোট ছোট পাহাড়গুলো ‘টেল’ নামে পরিচিত। টেল খুঁড়ে তা থেকে প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষ থেকে জানা যায় যে, তারা পাথরের বিকল্প হিসাবে ব্রোঞ্জ ধাতুরও ব্যবহার শুরু করেছিল। তামা ও টিনের সংমিশ্রণে গঠিত ব্রোঞ্জ ধাতুর আবিষ্কারক মূলত তারাই। অর্থাৎ এই সভ্যতা প্রস্তর যুগ থেকে ধাতুর যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
মেসোপটেমিয়া সভ্যতার ভাগসমূহ
মেসোপটেমিয়া সভ্যতার চারটি ভাগ ছিল-
- সুমেরীয় সভ্যতা
- ব্যাবিলনীয় সভ্যতা
- আসিরীয় সভ্যতা এবং
- ক্যালডীয় সভ্যতা ।
মেসোপটেমিয়া সভ্যতার বৈশিষ্ট্যসমূহ:
সামাজিক কাঠামো
মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় কঠোর সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস লক্ষ করা যায়। উপরের শ্রেণিতে থাকা পুরোহিত ও সম্ভ্রান্ত শ্রেণির লোকেরা সকল সুবিধা ভোগ করত। তারপর ব্যবসায়ী ও কারিগর শ্রেণি এবং তার নিচে ছিল কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি।
সমাজে দাস-দাসীরও ব্যাপক প্রচলন ছিল।
নারীরা গৃহস্থালি কাজ ছাড়াও ব্যবসা এবং ধর্মীয় কাজে যুক্ত ছিল।
অর্থনীতি
মেসোপটেমিয়ার অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। তাদের সেচব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত ছিল, যা টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর পানি ব্যবহার করে পরিচালিত হতো।
তাদের প্রধান বৃক্ষ ছিল খেজুর গাছ। যাকে তারা ‘প্রাণ বৃক্ষ’ বলত।
দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের জন্য অথবা কৃষিকাজের সুবিধার্থে তারা বিভিন্ন প্রকার মাটির পাত্র তৈরি করতেও দক্ষ ছিল।
প্রথম দিকে বিনিময় প্রথা চালু থাকলেও ব্রোঞ্জ আবিষ্কারের পর তারা নগর কেন্দ্রিক বাণিজ্য শুরু করে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
মেসোপটেমিয়ানরা দক্ষ কৃষক ছিল। উদ্বৃত্ত ফসল তারা মন্দিরে জমা রাখত। এই হিসাব রাখতেই পুরোহিতদের হাত ধরে গণিতের জন্ম হয়। পাটিগণিত ও জ্যামিতির ব্যবহার ছাড়াও গণিতের কিছু জটিল নিয়ম তারা রপ্ত করেছিল। গণনার জন্য তারা ষাটভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহার করত।
এখান থেকেই এক ঘন্টাকে ষাট মিনিট ও এক মিনিটকে ষাট সেকেন্ডে ভাগ করার রীতি চালু হয়। এমনকি তারা এক মাসকে ত্রিশ দিন এবং এক বছরকে বারো মাসে ভাগ করে। জলঘরি ও চন্দ্রপঞ্জিকার আবিষ্কার করে।
মেসোপটেমিয়ানদের মধ্যে অ্যাসেরীয়রা বৃত্তকে ৩৬০ ডিগ্রিতে ভাগ করে। পৃথিবীকে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশে ভাগ করে।
ক্যালডিয়রা সপ্তাহকে ৭ দিন এবং প্রতিদিনকে ১২ জোড়া ঘন্টায় ভাগ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করে।
তারা ১২টি নক্ষত্রপুঞ্জের সন্ধান পান। যা থেকে পরবর্তীতে ১২টি রাশি চক্রের সৃষ্টি হয়।
এদিকে সুমেরীয়রা চাকা আবিষ্কার করেন। তবে এ চাকা যাতায়াতের জন্য নয়। এটি সেঁচ ব্যবস্থা, খাল খনন, দালান নির্মাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো আরও সহজে ও কম সময়ে সম্পাদনের জন্য ব্যবহৃত হতো।
তবে মেসোপটেমিয়ানদের মধ্যে ব্যবিলনীয়রা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সবচেয়ে উন্নত ছিল। ব্যাবিলনের উত্তরের গাথুর শহরের ধ্বংসাবশেষেই পৃথিবীর প্রাচীনতম মানচিত্র পাওয়া যায়।
ভাষা ও সাহিত্য
মেসোপটেমিয়ানরা সেমিটিক ভাষায় কথা বলত। সুমেরীয়গণ ‘কিউনিফর্ম’ নামে নতুন লিপির উদ্ভাবন করেছিল; যা পৃথিবীর প্রাচীন লিপিগুলোর একটি। মাটির ফলকে ছবি একে একে প্রকাশ করা হতো এ লিপিকে। মহাকাব্য ‘গিলগামেশ’ এ লিপিতেই লেখা। মৃত্যুকে হারানো বা মানুষের অমরত্বের ইচ্ছা নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই মহাকাব্য।
আইন
শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার লক্ষ্যে আইনের প্রচলনও (ব্যাবিলনীয়রা তথা) মেসোপটেমিয়ানরাই করেছিল। সুমেরিয় শাসক উর নামু সর্বপ্রথম পৃথিবীর ইতিহাসে লিখিত আইনের প্রবর্তন করেন। যা ‘কোড অফ উর নামু’ নামে পরিচিত।
ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় হাম্মুরাবির (খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৯২-১৭৫০ ৪২ বছর) লিখিত আইন ‘হাম্মুরাবি কোড’-এ ২৮২টি আইন লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল।
স্থাপত্য ও শিল্প
মেসোপটেমিয়ানরা ইট ও কাদার ব্যবহার জানত। তাদের শিল্পকর্ম ও ভাস্কর্যের মধ্য ছিল দেব-দেবী ও রাজাদের মূর্তি।
জিগুরাট ছিল স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন।
ক্যালডীয় সভ্যতার স্থপতি সম্রাট নেবুচাদনেজার সম্রাজ্ঞীকে খুশি করার উদ্দেশ্যে ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান নির্মাণ করেছিলেন। যা পৃথিবীর প্রাচীন সপ্তাশ্চার্যের একটি।
ধর্ম ও দর্শন
মেসোপটেমিয়ানরা বহু ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিল। জিগুরাট নামে পিরামিড আকৃতির মন্দিরে তারা দেবতার উপাসনা করত।
তারা বিশ্বাস করত পৃথিবী খোলা যায়গায় অবস্থিত একটি গোলাকার চ্যাপ্টা চাকতি। এর উপরে স্বর্গ এবং নিচে নরক রয়েছে। পৃথিবীর চারদিকে রয়েছে জল।
অবশ্য পরবর্তীতে তারা বোঝতে পেরেছিল পৃথিবী গোলাকৃতির।
তারা বিশ্বাস করত মৃত্যুর পর আত্মা একটি অন্ধকার জগতে প্রবেশ করে।
শেষ পরিণতি
কোনো প্রাকৃতিক সুরক্ষা না থাকায় মেসোপটেমিয়ানদের বারবার বিদেশী আক্রমণের শিকার হতে হয়েছিল। বহিঃশত্রুর আক্রমণ, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার কারণে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার পতন ঘটেছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০ অব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চলটি পার্সিয়ানদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তারপর রোমান (২৫০ বছর), তারপর আবার পার্সিয়ানদের নিয়ন্ত্রণে আসে। সপ্তম শতকে মুসলিম শাসন শুরু হলে অঞ্চলটির নামকরণ করা হয় ইরাক।
মেসোপটেমিয়ানদের অবদান
হিংস্র পশু ও বন্য শুয়রের আক্রমণে মেসোপটেমিয়ানদের জীবন ও ফসলের ক্ষতি হতো। প্রাকৃতি দুযোর্গ যেমন বন্যায় প্রায়ই ভাসিয়ে নিয়ে যেত তাদের ঘর বাড়ি, গৃহপালিত পশু। তবুও তারা টিকে থেকেছে। মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর প্রথম লিখন পদ্ধতি, প্রথম আইনসংহিতা, নগর পরিকল্পনা এবং সেচব্যবস্থার উন্নতি, জ্যোতির্বিদ্যা এবং গণিতের বিকাশ মেসোপটেমিয়ানদের হাত ধরেই হয়েছিল। মানব সমাজকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে আসার জন্য মিসোপটেমিয়ানদের এসব আবিষ্কার অপরিহার্য ছিল। তাদের আবিষ্কারই আমাদের বর্তমান সভ্যতার ভিত্তি রচনা করেছে। ইতিহাস তাদের কখনও ভুলবে না।
যা হউক সংক্ষিপ্ত পরিসরে এই ছিল লিখন পদ্ধতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, আইন; তথা সভ্যতার জন্মকথা। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে মানুষ কীভাবে এই সভ্যতার যুগে পৌঁছাল? শিকারী সমাজ তথা বন্য মানুষ কীভাবে সভ্যতার যুগে এসে সভ্য মানুষে পরিণত হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে আগ্রহীরা “মানুষের ইতিহাস” সিরিজটি পড়তে পারেন।