আফ্রিকা মহাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নদ নীল নদ। এটি ভিক্টোরিয়া হ্রদ থেকে উৎপন্ন হয়ে বিভিন্ন দেশ হয়ে ভূমধ্যসাগরে এসে পতিত হয়েছে। নীল নদ না থাকলে আফ্রিকা মরুভূমিতে পরিণত হতো। এর মূল অববাহিকা ইজিপ্ট বা মিশর। তাই তো ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস বলেছিলেন, মিশর নীল নদের দান। খ্রি.পূ. ৫০০০ থেকে ৩১ খ্রি. পূর্বাব্দ পর্যন্ত নীল নদ তথা মিশরকে কেন্দ্র করে এই নদের অববাহিকায় প্রায় ৪ লক্ষ বর্গমাইল জুড়ে একটি সমৃদ্ধ জনপদ তথা সভ্যতার উদ্ভব হয়েছিল। ধর্ম, শিল্প, ভাস্কর্য, লিখন পদ্ধতি, বিজ্ঞান প্রতিটি ক্ষেত্রে এই সভ্যতার মানুষদের অবদান মানব সভ্যতার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সভ্যতাটির নাম মিশরীয় সভ্যতা। মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিশেষ অবদান রাখা এই সভ্যতা সম্পর্কে চলুন জেনে নেই।
ভৌগোলিক অবস্থান ও সময়
ইজিপ্ট দেশটি এশিয়া ও আফ্রিকা উভয় মহাদেশ জুড়ে অবস্থিত। এর পূর্বে লোহিত সাগর, পশ্চিমে সাহারা মুরুভূমি, উত্তরে ভূমধ্যসাগর এবং দক্ষিণে সুদান ও আফ্রিকা মহাদেশের অন্যান্য দেশসমূহ অবস্থিত। মিশরকে কেন্দ্র করেই মিশরীয় সভ্যতার জন্ম হয়েছিল। যার সূচনা হয় ৫০০০ খ্রি. পূর্বাব্দে নবপোলীয় যুগে।
৩২০০ খ্রি. পূ. থেকে প্রথম রাজ বংশের শাসনামল শুরু হয়। প্রাক রাজবংশীয় যুগে মিশর কতগুলো ছোট ছোট নগররাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। এদেরকে বলা হতো নোম। নারমার বা মেনেস নোমগুলোকে একত্র করে একটি রাজ্য গড়ে তুলেন। রাজ্যটির রাজধানী ছিল মেম্ফিসে। তিনি হন মিশরের প্রথম নরপতি ও পুরোহিত। তিনি প্রথম ফারাও এর মর্যাদা লাভ করেন। শুরু হয় ফারাওদের অধীনে রাজবংশের বংশানুক্রমিক শাসন। ফারাওরা ছিল অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। তারা নিজেদের সূর্যদেবতার বংশধর বলে মনে করত।
৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট মিশর দখল করলে মিশরীয় সভ্যতার পতন হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩১ অব্দে আদি রোমান সাম্রাজ্য মিশর অধিকার করে এই দেশকে একটি রোমান প্রদেশে পরিণত করলে ফারাওদের শাসন আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয়। এটি রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
মিশরীয় সভ্যতার বৈশিষ্ট্য
মিশরীয়দের জীবন ধর্মীয় চিন্তা ও বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত ছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই প্রভাব লক্ষণীয়। চলুন মিশরীয় সভ্যতার বৈশিষ্ট্যসমূহ জেনে নেই।
সমাজিক কাঠামো
মিশরীয় সভ্যতার সামাজিক কাঠামো ছিল অত্যন্ত সংগঠিত এবং স্তরবিন্যাসযুক্ত। পিরামিড আকৃতির এই কাঠামোর শীর্ষে ছিল
- শাসক তথা ফারাও এবং তার নীচে ধারাবাহিকভাবে
- পুরোহিত,
- উচ্চপদস্থ প্রশাসক এবং অভিজাত,
- লেখক, সৈন্য, কারিগর এবং শিল্পী,
- কৃষক এবং
- সবার নিচে দাস।
প্রতিটি স্তরের মানুষ নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও ভূমিকা পালন করত।
অর্থনীতি
নীল নদ ছিল মিশরের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। প্রতি বছর বন্যা কবলিত হওয়ায় নীল নদ অববাহিকার ভূমি বেশ উর্বর ছিল। ফলে শস্য উৎপাদন বেশ ভালো হতো। গম, যব, তুলা, পেয়াঁজ, পিচফল ইত্যাদি ছিল তাদের প্রধান শস্য।
ব্যবসা বাণিজ্যেও তারা যথেষ্ট অগ্রগামী ছিল। গম, লিনেন কাপড়, মাটির পাত্র ইত্যাদি তারা ক্রিট দ্বীপ, ফিনিশিয়া, ফিলিস্তিন ও সিরিয়ায় রপ্তানি করত। স্বর্ণ, রৌপ্য, হাতির দাঁত, কাঠ ইত্যাদি আমদানি করত।
কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত ফসলের একটি বড় অংশ কর হিসেবে জমিদার, মন্দির, এবং রাজপরিবারকে প্রদান করত। এটি রাজকীয় প্রকল্পগুলির জন্য তহবিল জোগাত।
বন্যার মৌসুমে, যখন কৃষি কাজ বন্ধ থাকত, তখন শ্রমিকরা রাজকীয় প্রকল্পে কাজ করত। পিরামিড নির্মাণ, মন্দির নির্মাণ ছাড়াও তারা গয়না, পাত্র, অস্ত্র, এবং তামা ও ব্রোঞ্জের বিভিন্ন পণ্য তৈরি করত।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
মিশরীয়রা জ্যোতিষশাস্ত্র, জোয়ার ভাটা, ভূমির পরিমাপ, জ্যামিতি ও পাটিগণিতের প্রচলন করে।
সিরিয়াস (Sirius) নামক তারকা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তারা নীল নদে বন্যার সময়সূচি অনুমান করতে পারত।
কর আদায় এবং জমির সীমানা নির্ধারণে মিশরীয়রা গণিতের ব্যবহার করত। তারা দশমিক পদ্ধতি এবং ভগ্নাংশ সম্পর্কে জানত। যোগ, বিয়োগ ও ভাগের ব্যবহার জানত। সর্বোপরি পিরামিড নির্মাণ তাদের জ্যামিতি এবং স্থাপত্যের অসাধারণ দক্ষতার পরিচায়ক।
৪২০০ খ্রি. পূর্বাব্দে তারা ৩৬৫ দিনের সৌরপঞ্জিকা আবিষ্কার করে। সূর্যঘড়ি, ছায়াঘড়ি, জলঘড়ি তাদের অবদান।
মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য তারা মমি তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিল। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চিকিৎসা করার পদ্ধতিও তাদের জানা ছিল। হাড় জোড়া লাগানো, হৃৎপিন্ডের গতি, নাড়ির স্পন্দন ও বেশ কয়েকটি রোগ নির্ণয় করা জানত তারা।
ভাষা ও সাহিত্য
মিশরীয়রা প্রথমদিকে ছবি একে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করত। এই লিখন পদ্ধতির নাম ছিল হায়ারোগ্লিফিক বা পবিত্র অক্ষর। ৫০০০ বছর পূর্বে তারা ২৪টি ব্যঞ্জনবর্ণের বর্ণমালা আবিষ্কার করে।
নলখাগড়া গাছের কান্ড থেকে কাগজ তৈরি করে তাতে মিশরীয়রা লিখত। গ্রিকদের কাছে এটি ‘প্যাপিরাস’ নামে পরিচিত। এখান থেকেই ইংরেজি ‘পেপার’ শব্দটি আসে।
উল্লেখ্য নেপোলিয়ান বোনাপার্টের মিশর জয়ের সময় একটি পাথর আবিষ্কৃত হয় যা ‘রসেটা স্টোন’ নামে পরিচিত। এতে গ্রিক এবং হায়ারোগ্লাফিক ভাষায় অনেক লেখা ছিল, যা থেকে প্রাচীন মিশর সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।
তারা দর্শন ও সাহিত্যচর্চাও করত। তাদের লেখাতে দুঃখ হতাশার কোন ছাপ ছিল না। তারা আশাবাদী ছিল। তাদের লেখাতে সব সময়ই আনন্দের প্রকাশ দেখা গিয়েছে।
ধর্ম ও বিশ্বাস
মিশরীয়দের মতে, সূর্যদেবতা রে বা আমন রে, প্রাকৃতিক শক্তি, শস্য ও নীল নদের দেবতা ওসিরিস মিলিতভাবে সমগ্র পৃথিবী পরিচালিত করেন। এদের মধ্যে সূর্য দেবতার গুরুত্ব বেশি। ফারাওদের তারা সূর্যদেবতার বংশধর মনে করত।
তারা বিশ্বাস করত মৃত ব্যক্তি এক সময় জীবিত হয়ে উঠবে। এই বিশ্বাস থেকেই মমি ও পিরামিড সৃষ্টি হয়। ফারাও খুফুর পিরামিড সবচেয়ে বড় পিরামিড।
তারা জড়বস্তুর পূজা, মূর্তিপূজা, জীবজন্তুর পূজা করত।
স্থাপত্য ও শিল্প
মিশরীয়দের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য হচ্ছে মিশরের গিজাতে অবস্থিত চুনাপাথরের বিশাল মূর্তি। যাকে স্ফিংক্স নামে ডাকা হয়। এর দেহ সিংহের মতো কিন্তু মাথা মানুষের।
বিশ্ববিখ্যাত পিরামিড সৃষ্টিও মিশরীয়দের অবদান; যা ফারাওদের মৃতদেহ রাখার জন্য বানানো হয়েছিল।
সমাধি ও মন্দিরের দেয়াল সাজাতে গিয়ে মিশরীয়রা শিল্পের সূচনা করে। সাদা কালো রং তাদের যথেষ্ট প্রিয় ছিল। তখনকার চিত্রে তারা সে সময়কার রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের কাহিনি ফুটিয়ে তুলত।
তারা কারুশিল্পেও যথেষ্ট উন্নত ছিল।
মিশরীয় সভ্যতা আজও বিশ্বের মানুষের কাছে বিস্ময় এবং আকর্ষণের বিষয়। বিশেষ করে পিরামিড, মমি এবং হাইরোগ্লিফিক্স-এর মাধ্যমে আমরা তাদের উন্নত ও বিষ্ময়কর প্রতিভা সম্পর্কে জানতে পারি। মানব ইতিহাসে এটি অমর হয়ে থাকবে। মিশরীয় সভ্যতার মতোই পৃথিবীর প্রাচীনতম আর একটি সভ্যতার নাম মেসোপটেমীয়া সভ্যতা।